পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও তার বিভিন্ন অজানা তথ্য সম্পর্কে আলোচনা
এক নজরে জানব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য (West Bengal Facts)
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি রাজ্য, যার উত্তর দিকে বঙ্গোপসাগর। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, রাজ্যটির জনসংখ্যা ৯ কোটি ১৩ লক্ষের বেশি, যা পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের জনসংখ্যার নিরিখে চতুর্থ স্থানে রাখে। রাজ্যের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে দার্জিলিং হিমালয়, গাঙ্গেয় বদ্বীপ, রাঢ় অঞ্চল এবং সুন্দরবনের উপকূলীয় অংশ রাজ্যটির অন্তর্ভুক্ত। বাঙালি এখানে প্রধান জাতিগোষ্ঠী এবং হিন্দুধর্ম রাজ্যের প্রধান ধর্ম।
পশ্চিমবঙ্গের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রাচীন বাংলায় বহু গুরুত্বপূর্ণ জনপদের বিকাশ ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোক এই অঞ্চল জয় করেন এবং চতুর্থ শতকে এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। দশম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অঞ্চলটি বিভিন্ন সুলতান, শক্তিশালী হিন্দু রাজা এবং বারো ভুঁইয়াদের শাসনে ছিল। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানকার শাসনভার গ্রহণ করে। এর পরবর্তী সময়ে, কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার শুরু হয়, যা পরে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত।
উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়, যা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে, পশ্চিমভাগ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠিত হয়। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার টানা শাসন করে, যা বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাম্যবাদী সরকার হিসেবে পরিচিত।
পশ্চিমবঙ্গের নামকরণ: ইতিহাস ও তথ্য
পশ্চিমবঙ্গের নামকরণের ইতিহাস জানার জন্য প্রথমে প্রাচীন গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিডাই সভ্যতার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এটি গঙ্গানদীর মোহনায় অবস্থিত একটি প্রাচীন সভ্যতা ছিল, যার উল্লেখ গ্রিক রচনাতেও পাওয়া যায়। তবে, এই সভ্যতা থেকে কীভাবে 'বঙ্গ' বা 'বাংলা' নামের উৎপত্তি হয়েছে, তা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য মেলেনি।
বঙ্গ নামের সম্ভাব্য উৎস
দক্ষিণ ভারতের একটি জনজাতি, যারা বর্তমানে ঝাড়খণ্ডে বসবাস করে, তাদের সূর্যদেবতার নাম ছিল সিঙ্গ বঙ্গা। অনেকেই মনে করেন, বঙ্গ নামটি এখান থেকেই এসেছে। অন্যদিকে, আর্যদের বর্ণনামতে রাজা বলি এই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরে পাওয়া একটি প্রাচীন লিপিতে ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, যা খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর বলে ধারণা করা হয়।
বাংলা নামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার শাসক হন এবং ‘শাহ-ই-বাংলা’ উপাধি ধারণ করেন। বাংলা সাহিত্যে এই ভূখণ্ডকে ‘বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা গানেও ‘বাংলা’ নামটির উল্লেখ রয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বাংলাদেশ’ কবিতাতেও একইভাবে এই অঞ্চলের নাম উঠে এসেছে।
বিভাজন ও নামকরণ
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলেও তা স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় বাংলার পশ্চিম অংশ ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে পরিচিত হয় এবং পূর্ব অংশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশ ভাগের স্মৃতি এখনো পশ্চিমবঙ্গ বহন করে চলছে।
পশ্চিমবঙ্গ নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টা
১৯৯০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলের আলোচনা শুরু হয়। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ‘Paschimbanga’ নামকরণের প্রস্তাব দেয়। ২০১৬ সালে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের জন্য তিনটি বিকল্প নাম (বাংলা, বেঙ্গল, ও বঙ্গাল) প্রস্তাব করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তিতে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১৮ সালের ২৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘বাংলা’ নামটি সব ভাষার জন্য প্রস্তাবিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন মিললে, পশ্চিমবঙ্গের নাম শীঘ্রই ‘বাংলা’তে পরিবর্তিত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ: অবস্থান, সীমানা, আয়তন, রাজধানী এবং সংস্কৃতি
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গ ভৌগোলিকভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। রাজ্যটি ২১°৩১' উত্তর অক্ষাংশ থেকে শুরু করে ২৭°১৪' উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং ৮৫°৯১' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°৯৩' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
কর্কটক্রান্তি রেখা পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটি নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর ও ধুবুলিয়া, বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী, গুসকরা, আউসগ্রাম, রাজবাঁধ, দুর্গাপুর, বাঁকুড়া জেলার দুর্লভপুর এবং পুরুলিয়া জেলার আর্দ্রা শহরের উপর দিয়ে প্রসারিত।
পশ্চিমবঙ্গের সীমানা
রাজ্যের উত্তরে সিকিম ও ভুটান, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, বিহার ও নেপাল এবং পূর্বে আসাম ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-সীমানা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘ (প্রায় ২,২৯২ কিমি)। উত্তর-দক্ষিণে রাজ্যের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬২৩ কিমি এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ প্রায় ৩২০ কিমি।
রাজ্যের উত্তর অংশ হিমালয় পর্বতমালার স্পর্শে রয়েছে, আর দক্ষিণ অংশে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার বদ্বীপ এবং বঙ্গোপসাগর বিস্তৃত। পশ্চিমবঙ্গ তিনটি বিদেশি রাষ্ট্র – নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশ এবং পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য – সিকিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং আসাম দ্বারা পরিবেষ্টিত। ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গেও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান।
পশ্চিমবঙ্গের আয়তন
পশ্চিমবঙ্গের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গকিমি (৩৪,২৬৭ বর্গমাইল)। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, রাজ্যের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮,০২,২১,১৭১ জন। প্রতি বর্গকিমিতে জনঘনত্ব ৯০৪ জন, যা ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ। লিঙ্গানুপাত অনুযায়ী প্রতি ১০০০ জন পুরুষের বিপরীতে মহিলার সংখ্যা ৯৩৪ জন। জনসংখ্যার অধিকাংশই বাঙালি সম্প্রদায়ভুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা, যা ‘City of Joy’ নামে পরিচিত। এটি ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও খ্যাত। কলকাতা বন্দর ভারতের প্রাচীনতম নদীবন্দরগুলির একটি।
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা মূলত বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, চারুকলা, নাটক এবং চলচ্চিত্রে গভীরভাবে প্রোথিত।
সাহিত্য ও শিল্প: বাংলা সাহিত্যের বর্ণময় ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কবি-সাহিত্যিকরা অমর হয়ে আছেন।
সঙ্গীত: রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, এবং লোকসঙ্গীত পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ।
উৎসব: দুর্গাপুজো হল রাজ্যের প্রধান উৎসব, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিখ্যাত। এছাড়া পয়লা বৈশাখ, রথযাত্রা, কালীপুজো, এবং ঈদ এখানকার প্রধান উৎসব।
খাদ্য: পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত খাদ্যের মধ্যে রয়েছে মাছ-ভাত, শুক্তো, রসগোল্লা এবং সন্দেশ।
নৃত্য ও নাটক: ছৌ নৃত্য এবং যাত্রাপালা এখানকার ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
অতিরিক্ত তথ্য
- পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম আকর্ষণ হল সুন্দরবন, যা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান।
- দার্জিলিংয়ের চা এবং এখানকার খেলনা ট্রেন বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ।
- পশ্চিমবঙ্গ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
- রাজ্যটি বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন, যেমন হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, দক্ষিণেশ্বর মন্দির এবং শান্তিনিকেতন দিয়ে সমৃদ্ধ।
- পশ্চিমবঙ্গ তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য শুধু ভারতের নয়, বিশ্ব মানচিত্রেও বিশেষভাবে স্বীকৃত।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব | Specialty of West Bengal
পশ্চিমবঙ্গ তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের জন্য সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এখানে ভারতের প্রাচীন স্থাপত্য থেকে শুরু করে আধুনিক শহরগুলির চিহ্ন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্বগুলো নিম্নরূপ:
চা উৎপাদনের শ্রেষ্ঠত্ব
- পশ্চিমবঙ্গ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী রাজ্য।
- দার্জিলিং চা, যা 'চায়ের রাজা' নামে পরিচিত, বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এটি ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃত একটি জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত পণ্য।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গৌরব
- ভারতের প্রথম রাজধানী ছিল কলকাতা, যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
- এখানে বহু সাহিত্যিকের জন্মভূমি, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং বিদ্যাসাগর।
- কলকাতা হল 'ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী' এবং আধুনিক বাংলার মূল কেন্দ্র।
পর্যটন ও প্রকৃতি
- পশ্চিমবঙ্গের বোটানিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম বটগাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
- সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল।
- দার্জিলিং এবং কালিম্পং পর্যটনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, যেখানে হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
পরিকাঠামো ও পরিবহন
- হাওড়া ব্রিজ, বিশ্বের ব্যস্ততম সেতু, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম চিহ্ন।
- খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশন ভারতের অন্যতম দীর্ঘ প্ল্যাটফর্ম।
- কলকাতার মেট্রো রেলওয়ে ছিল ভারতের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো প্রকল্প।
খেলাধুলা ও বিনোদন
- ফুটবলের জন্য বিখ্যাত পশ্চিমবঙ্গে ভারতের প্রথম ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়।
- ইডেন গার্ডেন, ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এবং বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোর একটি।
- রাজ্যের বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠিত চৌকস ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং লোকনৃত্য সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি বহন করে।
খাদ্য ও রন্ধনশৈলী
- পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী খাবার মাছ-ভাত।
- রসগোল্লা, মিষ্টি দই, শুক্তো, লুচি-আলুর দম এখানকার বিখ্যাত খাবার।
- চাইনিজ রন্ধনশৈলীর সাথে বাঙালি খাবারের সংমিশ্রণও পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়।
উৎসব ও পার্বণ
- পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজা কেবল রাজ্যের নয়, ভারতের এবং বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব।
- কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, রথযাত্রা এবং পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবগুলি রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
- বিশ্বের একমাত্র স্থান যেখানে শ্রমসাধ্য হাতে টানা রিকশা এখনও চালু রয়েছে।
- পশ্চিমবঙ্গে চীন থেকে আসা মানুষজন স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, যা রাজ্যের বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে।
- এখানকার পোশাক এবং শিল্পকলা যেমন বালুচরী শাড়ি, কান্থা সেলাই, এবং তেরাকোটা শিল্প বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
Q1) পশ্চিমবঙ্গকে একটি উন্নত রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় কেন ?
উত্তর: - সার্বিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গকে উন্নত রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করার কারণগুলি নিম্নরূপ -
১.কৃষিক্ষোয় অগ্রগতি : পশ্চিমবঙ্গ কৃষিক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ভারতের মধ্যে ধান ও পাট উৎপাদনে এই রাজ্য প্রথম স্থান অধিকার করে। এ ছাড়াও গম, তৈলবীজ, ডালশস্য, শাকসবজি ইত্যাদি উৎপন্ন হয় যা রাজ্যের অর্থনীতিকে অনেক বেশি উন্নত করেছে ।
২. মৎস্য শিল্পে উন্নতি : পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে সমুদ্র থাকায় এবং এটি একটি নদীমাতৃক রাজ্য হওয়ায় এখানে মাছধরা ও মাছচাষের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাপক পরিমাণে মাছ উৎপাদিত হয়।
৩. শিল্পাক্ষাত উন্নতি :
(i) পশ্চিমবঙ্গ পাঠ উৎপাদনে সারা ভারতবর্ষের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভাগীরথী ও হুগলি নদীর তীরবর্তী পাটকলগুলির জন্য পাটশিল্প অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে।
(ii) এখানে দুর্গাপুরে লৌহ-ইস্পাত শিল্প, চিত্তরঞ্জনে রেলইঞ্জিন নির্মাণ শিল্প, হলদিয়ায় পেট্রোরসায়ন শিল্প গড়ে উঠেছে।
(iii) এছাড়া কাগজ, রাসায়নিক শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ উন্নত। কলকাতার সল্টলেক অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
(iv) কুটির শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে প্রথম স্থান অধিকার করে।
৪. বিদ্যুৎ উৎপাদন : বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পশ্চিমবঙ্গ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এখানে ব্যান্ডেল, বজবজ, কোলাঘাট, সাঁওতালডিহিতে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, ফারাক্কায় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এখানে সৌরবিদ্যুৎও কিছু অংশে প্রচলিত।
৫. বাণিজ্য : পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা সমগ্র পূর্ব- ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যক্ষেত্র।
৬. পরিবহণ :
(i) এই অঞ্চল সড়ক পরিবহণে উন্নত। এই রাজ্যের উপর দিয়ে 2, 6, 34, 35, 41 নং জাতীয় সড়ক গেছে।
(ii) পূর্ব রেলের সদর দপ্তর কলকাতা। শিয়ালদহ ও হাওড়ার মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন থেকে প্রতিনিয়ত অজস্র ট্রেন রাজ্যের ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করে।
(iii) দমদম বিমানবন্দর পূর্ব ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
(iv) এ ছাড়া কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর জলপথে পরিবহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(v) পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার এবং বক্সাদুয়ার ভুটানের প্রবেশদ্বার' হওয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি পশ্চিমবঙ্গের আরো কাছে এসেছে।
টিকা লেখো : - পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
১. তিনবিঘা করিডর : -
উত্তর: - পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ-কুচলিবাড়ি অঞ্চলের তিন বিঘা জমি ভারত সরকার 1992 সালের 26 জুন বাংলাদেশ সরকারকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য লিজ দিয়েছে বাংলাদেশের দহগ্রাম ও পানবাড়ি ছিটমহলের মধ্যে যাতায়াতের জন্য। এই সংকীর্ণ একফালি জমিই ‘তিনবিঘা করিডর' নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের এই অংশ ছিটমহল নামে পরিচিত।
২. উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার : -
উত্তর: - উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, যেমন - সিকিম, অসম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড প্রভৃতির সঙ্গে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ রক্ষা করে চলেছে শিলিগুড়ি শহরটি। তাই শিলিগুড়িকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বলে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঔষধ, যন্ত্রপাতি, বস্ত্র, রাসায়নিক দ্রব্য, খাদ্যদ্রব্য, কয়লা, লবণ শিলিগুড়ির মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রেরিত হয় এবং সেখান থেকে বনজ, কৃষিজ, খনিজ সম্পদ পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়।
৩. গোর্খাল্যান্ড : -
উত্তর: - পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চল অধ্যুষিত নেপালি সম্প্রদায় গোর্খা নামে পরিচিত। এই সমস্ত গোর্খা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন অক্ষুণ্ণ রাখতে একটি পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দাবি জানায়। সেই প্রস্তাবিত রাষ্ট্রই গোর্খাল্যান্ড নামে পরিচিত। 1980 সালে গোর্খাল্যান্ড ন্যাশানাল লিবারেশান ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে দার্জিলিং, ডুয়ার্স ও শিলিগুড়ি নিয়ে গোর্খাল্যান্ডের প্রথম দাবি জানানো হয়।
৪. চুখা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : -
উত্তর : - চুখা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ভারত সরকার ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে। ভুটানের তিচু ও ওয়াংচু নদীর মিলনস্থলে চুখা বলে একটি স্থানে এই প্রকল্পটি স্থাপন করা হয়েছে। এই প্রকল্পটির 336 মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে ৷ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভুটান এবং পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
৫. সুন্দরবন অঞ্চল : -
উত্তর :- উত্তর দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার দক্ষিণাংশে প্রায় 4,110 বর্গকিমি অরণ্যময় ভূভাগের নামই সুন্দরবন। এই অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গভীর বনভূমি গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে সুন্দরী গাছের প্রাধান্য দেখা যায়। ওই গাছের নাম অনুসারেই এই অরণ্যের নাম সুন্দরবন হয়েছে। এই অরণ্য পৃথিবী বিখ্যাত 'রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার'-এর বাসভূমি। এই বনভূমির সীমানা নির্ণয় করা হয় 1830 সালে দুই ইংরেজ সার্ভে অফিসার ডাম্পিয়ার ও হজেস-এঁর দ্বারা। তাঁদের দ্বারা চিহ্নিত সুন্দরবনের সীমানারেখার নামই ডাম্পিয়ার-হজেস রেখা। বর্তমানে অরণ্য ধ্বংস ও বাসভূমি বিস্তারের ফলে সুন্দরবনের প্রকৃত সীমা অনেকটাই দক্ষিণে সরে গেছে।
৬. ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ (Mangrove) : -
উত্তর :- উত্তর সমুদ্রের উপকূলবর্তী অঞ্চলে কিছু বিশেষ ধরণের উদ্ভিদ পাওয়া যায়, যেগুলি শারীরবৃত্তীয় অভিযোজনের মাধ্যমে কঠিন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেয়। এই উদ্ভিদগুলো শ্বাসমূল তৈরি করে বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন সংগ্রহ করে, ঠেসমূলের মাধ্যমে নিজেদের স্থায়িত্ব বজায় রাখে এবং জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে নতুন চারাগাছ জন্মায়। লবণাক্ত মাটির মধ্যে প্রতিকূল অবস্থায় বেঁচে থাকার এই সক্ষমতার জন্য এই উদ্ভিদগুলিকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলা হয়। এগুলি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকূলীয় এলাকায় মাটির ক্ষয় রোধ করে।
প্রাপ্তিস্থান : পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ 24 পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। উদাহরণ – সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হোগলা, গোলপাতা, ক্যাওড়া, ছাতিম, ধুঁদুল, পিঠালি ইত্যাদি।
ব্যাবহারিক গুরুত্ব : এই উদ্ভিদের পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া হয়। ও এই উদ্ভিদগুলির কাঠ জ্বালানিরূপে ও গৃহনির্মাণের উপকরণ- রূপে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এই অরণ্যে মোম ও মধু পাওয়া যায়। • ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও সুন্দরবনের সৌন্দর্য এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
Frequently Asked Questions about West Bengal
প্রশ্ন ১: পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস কী?
উত্তর: দার্জিলিং চা, দুর্গাপূজা, হাওড়া ব্রিজ, এবং রসগোল্লা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত।
প্রশ্ন ২: পশ্চিমবঙ্গের খাওয়ার বৈচিত্র্য কীভাবে অনন্য?
উত্তর: এখানকার মাছ-ভাত, রসগোল্লা, মিষ্টি দই, চিংড়ি মালাইকারি, এবং চাইনিজ-বাঙালি খাবার ভারতের অন্য কোনো অঞ্চলে তেমনভাবে দেখা যায় না।
প্রশ্ন ৩: পশ্চিমবঙ্গের খেলাধুলায় বিশেষত্ব কী?
উত্তর: ফুটবল এবং ক্রিকেটে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব রয়েছে। ইডেন গার্ডেন ও মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব এর প্রমাণ।
প্রশ্ন ৪:পশ্চিমবঙ্গের প্রধান খনিজ সম্পদ কি?
উত্তর :- কয়লা।
প্রশ্ন ৫: পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কয়লা খনি রয়েছে?
উত্তর : - রানিগঞ্জে।